রবিবার, অক্টোবর ৫, ২০২৫
spot_img
Homeএই মুহুর্তেপাঁচ ব্যাংকের শেয়ারে রেকর্ড পতন, ৩ মাসে বাজারমূল্য কমেছে ৯২৬ কোটি টাকা

পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারে রেকর্ড পতন, ৩ মাসে বাজারমূল্য কমেছে ৯২৬ কোটি টাকা

প্রাইম ভিশন ডেস্ক »

একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারমূল্যে গত এক বছরে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে উদ্বিগ্ন ইকুইটি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার বিক্রির চাপে মাত্র তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ব্যাংকগুলোর মোট বাজারমূল্য কমেছে ৯২৬ কোটি টাকা।

২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এই পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারদর রেকর্ড সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছায়। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর বিপরীতে ২.৬ টাকায়, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ১.৮ টাকায়, ইউনিয়ন ব্যাংকের শেয়ার ১.৯ টাকায়, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ৪.৪ টাকায় ও এক্সিম ব্যাংকের শেয়ার ৪.০ টাকায় নেমে আসে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, এদের মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারমূল্য সবচেয়ে বেশি পড়েছে। গত তিন মাসে ব্যাংকটির শেয়ার বাজারমূল্য হারিয়েছে ৩৪২ কোটি টাকা।

তবে সময়সীমা যদি ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত—অর্থাৎ যখন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়—পেছানো হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। গত ১৩ মাসে এই পাঁচ ব্যাংকের সম্মিলিত বাজারমূল্য কমেছে ২ জাকার ২৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু এক্সিম ব্যাংকের বাজারমূল্য কমেছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা, আর গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের কমেছে ৪৮৩ কোটি টাকা।

মোট শেয়ারের সঙ্গে বাজারমূল্য হিসাবে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট পাঁচটি ব্যাংকের সম্মিলিত বাজারমূল্য ছিল ৪ হাজার ৪৩ কোটি টাকা।

ওই সময় ব্যাংকগুলোর শেয়ারের মূল্য ছিল ৬.১ থেকে ৮.১ টাকার মধ্যে। তবে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে শেয়ারদর দাঁড়ায় প্রতিটি ১.৮ টাকা থেকে ৪.৪ টাকার মধ্যে।

এই সময়ে কোনো কোনো ব্যাংকের শেয়ারের দাম সর্বোচ্চ ৭৩ শতাংশ ও সর্বনিম্ন ৩৮ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারে মোট বাজারমূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা।

বছর শেষে নিয়মিত লভ্যাংশের কারণে একসময় ব্যাংকের শেয়ারের বিনিয়োগ ছিল খুব আকর্ষণীয়। তবে দেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসের ব্যাংকের শেয়ার সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হলেও এখন ক্রেতা বা বিনিয়োগকারী কম।

একীভূতকরণের সিদ্ধান্তের সঙ্গে দুর্বল ভিত্তি ও বিনিয়োগকারীদের টলে যাওয়া আস্থা—সব মিলিয়ে এই খাতের ওপর একটি নেতিবাচক ছায়া ফেলেছে। ইক্যুইটি বিনিয়োগকারীরা এখন প্রশ্ন করছেন: এরপর কী?

শুধু একীভূত হতে যাওয়া পাঁচ ব্যাংকই নয়, পুরো ব্যাংকিং খাতই সংকটে রয়েছে। নানা অনিয়ম, লাগামহী খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এই খাতকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

এই অস্থিরতার মধ্যেই বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা সম্প্রতি তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোতে থাকা তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যাংক গঠনের সময় বিনিয়োগ করা শেয়ারও ছেড়ে দিচ্ছেন তারা।

পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মূলত চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গ্রুপটি সেকেন্ডারি মার্কেট থেকে বিভিন্ন কোম্পানির নামে শেয়ার কিনে ধীরে ধীরে এসব ব্যাংকের মালিকানায় আসে। পরে নিজেদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের পর্ষদে বসিয়ে নামে-বেনামে ঋণ নেয়, যার বড় অংশই এখন খেলাপি।

এখন গ্রাহকের আস্থা সংকট ও খেলাপি ঋণের বোঝায় জর্জরিত পাঁচ ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে একটি বড় ইসলাম ব্যাংক গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা অনুযায়ী, পাঁচটি ব্যাংক একত্রিত হয়ে একটি বড় ইসলামী ব্যাংক গঠন করা হবে।

অনিশ্চিত সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্য

একীভূত হলেও ব্যাংকের আমানতকারীরা মূলধন ফেরত পাবেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ করা সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের কী হবে, এ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির প্রতিবেদনের পরই একীভূতকরণের প্রক্রিয়ার বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন স্টেকহোল্ডাররা।

ব্যাংকগুলো একীভূত হলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ারের বিপরীতে কোনো টাকা পাবেন কি না, জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদবলেন, ‘বিনিয়োগকারীরা তাদের পাওনা অর্থ ফেরত পাবেন, এটি নিশ্চিত। কিন্তু এসব বিনিয়োগকারীরা তো ইকুইটি ইনভেস্টর। তাদের ক্ষেত্রে কী হবে, সে বিষয়ে আমি এখনই কোনো মন্তব্য করব না।’

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও স্বতন্ত্র পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘ব্যাংক মার্জার হলে আমানতকারী ও অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারহোল্ডাররা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন। সাধারণ শেয়ারহোল্ডার বা তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কিছুই পান না। তবে ওই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার করার নিয়ম আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকেও দাবি করা হয়েছে হয় তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক অথবা নতুন যে ব্যাংক গঠন করা হবে, তাতে শেয়ার দেওয়া হোক। বিনিয়োগকারীদের কমপেনসেট করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।’

অব্যাহতভাবে শেয়ারমূল্য কমার বিষয়ে নুরুল আমিন বলেন, ‘যেসব ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারছে না, সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তায় চলছিল। কিন্তু মার্জারের কারণে এখন সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোও খেলাপি ঋণ আদায় করতে পারছে না। ফলে কোনো কোনো ব্যাংকের কার্যক্রম কার্যত বন্ধ। এই অবস্থায় শেয়ারের দাম তো কমবেই।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ব্যাংক মার্জারের আওতায় এলে পুঁজিবাজারের শেয়ারহোল্ডারদের ফান্ড ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই।’

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, সম্প্রতি এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও ব্যাংক রেজোল্যুউশন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৈঠকে বিএসইসি চেয়ারম্যান জানতে চান, শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ ফেরত দেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না। গভর্নরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আইন অনুযায়ী এ সুযোগ নেই। এছাড়া সরকার থেকে যে তহবিল পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে ব্যাংকের ব্যক্তিগত পর্যায়ের আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়া হবে।

পাঁচ ব্যাংকের সম্পদ ও দায়

এক্সিম ব্যাংক: ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এক্সিম ব্যাংকের মোট দায়ের পরিমাণ ছিল ৫৯ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৯ হাজার ২৭০ কোটি টাকা আমানত, ২ হাজার ৯০ কোটি টাকা বন্ড ও ৪ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা অন্যান্য দায়। ব্যাংকটির ব্যালান্স শিট অনুযায়ী, সরকারি ও অন্যান্য সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ ছিল ৪ হাজার ৮১৪.৬৮ কোটি টাকা এবং সাধারণ বিনিয়োগ (মূলত বেসরকারি খাতে ঋণ ও বিল ক্রয়) ছিল ৫৪ হাজার ১৬৮ কোটি টাকা।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল ৬৭ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদ অর্থ, অন্যান্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা অর্থ, সরকারি সিকিউরিটিজ ও ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ এবং শিল্প খাতে ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ, অর্থাৎ শিল্প খাতে ঋণ ৬২ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ও স্থায়ী সম্পদ প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এই সম্পদের বিপরীতে মোট দায় ৪১ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা, যার বেশিরভাগই ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের মেয়াদি আমানত (২৭ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা)। ব্যাংকটির প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার বন্ড দায়ও ছিল।

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: জুন ২০২৫ শেষে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল ১৮ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা ছিল বিনিয়োগ, মূলত শিল্প খাতে ঋণ। এই ঋণের মধ্যে ১২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা মন্দ বা লস হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। ব্যাংকের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংকটির ১২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা প্রভিশন সংরক্ষণের কথা থাকলেও ছিল মাত্র ৩ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা; ফলে ঘাটতি ছিল ৮ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট দায় ছিল ২২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ১২ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা আমানত (অধিকাংশই ১০ হাজার ৬৪০ কোটি টাকার মেয়াদি আমানত) এবং স্থায়ী সম্পদ মাত্র ২০৫ কোটি টাকা।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: জুন ২০২৫ পর্যন্ত সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মোট সম্পদ ছিল ৪৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রধানত ছিল ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার সরকারি সিকিউরিটিজ ও শেয়ার এবং ৩৮ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার শিল্প খাতে ঋণ। স্থায়ী সম্পদ—যার মধ্যে রয়েছে অফিস, আসবাবপত্র ও অন্যান্য সরঞ্জাম—ছিল ৪০৭.৮১ কোটি টাকা। ব্যাংকটির মোট দায়ের পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৮ হাজার ১৫২ কোটি টাকা ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের আমানত এবং ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার সাবঅর্ডিনেটেড ও পারপেচুয়াল বন্ড ছিল।

ইউনিয়ন ব্যাংক: ইউনিয়ন ব্যাংক এখনও তাদের ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন বা ২০২৫ সালের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকটির মোট সম্পদ ছিল ৩০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৯ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও ২৭ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা শিল্প খাতে ঋণ। মোট দায় ছিল ২৮ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২২ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা আমানত ও অন্যান্য দায় এবং ১৭০ কোটি টাকার বন্ড ছিল।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

পাঠক প্রিয়