প্রাইম ভিশন ডেস্ক »
দেশে ব্যাংক খাতের এক অদ্ভুত বৈপরীত্য বিরাজ করছে। বড় ঋণখেলাপিরা কয়েক শ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ফেরত না দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অন্যদিকে ছোট ঋণের জন্য গরিব কৃষক কিংবা সাধারণ মানুষ সামান্য দেরি বা কয়েক শ টাকার ঘাটতি হলে কঠোর হয়রানির শিকার হন; এমনকি হাতকড়া পরানো অথবা কারাগারে পাঠানোরও নজির রয়েছে।
ঈশ্বরদীর ভাড়ইমারি গ্রামের নারী উদ্যোক্তা রহিমা বেগম ২০১৬ সালে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সুদসহ ৪৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেছিলেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে মাত্র ৯০০ টাকা বকেয়া থাকায় ২০২১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। একই গ্রামের কৃষক মজনু প্রামাণিকও ৪০ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে ৫৫ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর মামলার শিকার হন। শেষ পর্যন্ত উভয়কে খেলাপি মামলায় জেল খাটতে হয়।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের বিরুদ্ধে এ ধরনের সার্টিফিকেট মামলার বিধান থাকা উচিত নয়। মাত্র কয়েক শ বা কয়েক হাজার টাকার ঋণ থাকলে কেস টু কেস ভিত্তিতে মওকুফ করা উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘কৃষকের বিরুদ্ধে মাত্র ৫ হাজার টাকার জন্য মামলা করা কতটা ন্যায্য, সেটা সাধারণভাবে বলা মুশকিল।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে কৃষক ও ছোট ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১২৩টি, যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৯৩ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে মামলা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৮৩টি ও খেলাপি ৪০০ কোটি, আর ২০২২ সালে ১ লাখ ২২ হাজার ২৬৯টি মামলায় খেলাপি ছিল ৪১২ কোটি টাকা। সূত্র আজকের পত্রিকা।
ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে পাবনার কৃষক আতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমাদের কি মানসম্মান নাই? ৪০০ টাহার জন্যি জেল খাটা লাগল। হগলে মনে করল, কত টেহা জিনি মারে খাইছি। গেরামে মুখ দেহাবের পারিনে।’ মজনু প্রামাণিক বলেন, ‘৪০ হাজারে ১৫ হাজার সুদ দিলেম। তারপরেও জেলে গেলেম। ইডা কুন নিয়ম, বুঝলেম না। আমাগের এই হয়রানির বিচার চাই।’
তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৩টি মামলায় খেলাপি ঋণ ছিল ৪৩৯ কোটি টাকা। চার বছরে মামলা কমেছে ৩৪ হাজার ৬৭০টি এবং আদায় হয়েছে মাত্র ৪৬ কোটি টাকা। ফলে গড়ে প্রতিটি মামলায় অনাদায়ি অর্থ দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩২৬ টাকা।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ‘নোটিশ না দিয়ে কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করা নীতিবিরোধী। মাত্র ৪০০-৫০০ টাকার জন্য জেল ইস্যুর সমাধান জরুরি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংক মোট ২ লাখ ৫ হাজারের বেশি কৃষকের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলা করেছে। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কৃষকের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক; এরপর অগ্রণী, জনতা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন, রূপালী ও সোনালী ব্যাংক।