প্রাইম ডেস্ক »
পাম তেলের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বড় ধরনের সরবরাহ সংকট তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এই নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্রের সয়াবিন নির্ভর একটি ফিউচার্স সূচক– যা পাম তেলের একটি বিকল্প– শনিবার পর্যন্ত টানা তিনদিন ধরে রেকর্ড মূল্যে অবস্থান করছে। যুক্তরাজ্যে সুপারমার্কেটগুলো নিজেরা উদ্যোগী হয়ে ক্রেতাদের ভোজ্যতেল কেনা সীমিত করছে, যাতে সকলেই সমানভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যটি কিনতে পারে।
ভারত ভিত্তিক একটি বৈশ্বিক নিত্যপণ্য কারবারি সংস্থা তাদের একটি নোটে জানিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোজ্যতেলের দাম আকাশ ছুঁতে পারে।
ইন্দোনেশিয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে শনিবার দেশের সবচেয়ে বড় নিত্যপণ্যের বাজার– চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতিমণ (৪০ দশমিক ৯০ লিটার) পাম তেলের বিক্রয়মূল্য অন্তত ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
পাম তেল রপ্তানি বন্ধের এই আচমকা সিদ্ধান্ত সয়াবিন তেলের মূল্যেও উত্তাপ ছড়াচ্ছে। খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহে পাম ও সয়াবিন তেলের মূল্য মণপ্রতি ৭০০ থেকে ১১০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
দেশের বাজারে অন্যতম নিত্যপণ্য সরবরাহক সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা দ্বলেছেন, “বিশ্ববাজার থেকে কাঁচামালের সরবরাহ না পেলে আমরা তেল পরিশোধন বা উৎপাদন করতে পারব না।”
তিনি বলেন, বিকল্প হতে পারতো সূর্যমুখীর তেল, কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এটির সরবরাহও ব্যাহত হয়েছে। “অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের জন্য এখন বেশি বিকল্পও নেই, সুতরাং এর আঁচটা বাংলাদেশের ওপর আসবেই।”
নিত্যপণ্য ব্যবসার আরেক বড় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার মো. তাসলিম শাহরিয়ার টিবিএসকে বলেন, “আমরা যদি নিদেনপক্ষে কাঁচামাল আমদানিও না করতে পারি, তাহলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়ার উৎস বন্ধ হওয়ায়-পাম তেলের আরেকটি বড় রপ্তানিকারক দেশ মালয়েশিয়া বাড়তি চাহিদার চাপের মুখে পড়বে, কারণ ভারত ও চীনের মতো ভোজ্যতেলের বড় ক্রেতা দেশ সেখান থেকে সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে।
মহামারি সৃষ্ট পণ্য পরিবহনে বিচ্ছিন্নতা, কর্মী সংকট এমনকী বিরূপ আবহাওয়ার মতো কারণেও ২০২১ সাল থেকে ভেজিটেবল অয়েলের বাজার (উদ্ভিজ্জ উৎস যেমন- পাম, সয়াবিন, সূর্যমুখী ইত্যাদি) একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় যখন আন্তর্জাতিক বাজারে সরবরাহ সীমিত, তখন নিজের সুবিশাল ১৪১ কোটি জনসংখ্যার জন্য খাদ্য ও ভোজ্যতেল মজুদ বাড়িয়ে চলেছে চীন।
বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার রেদওয়ানুর রহমান বলেন, “চীনের মতো আগ্রাসী ক্রেতার কারণে আন্তর্জাতিক রান্নার তেলের বাজার কতটা নির্মম হয়ে উঠতে পারে, তা আমরা গত বছরই দেখেছি।”
চীনের আগ্রাসী ক্রয় আর তার সাথে ২০২২ সালের শুরু থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতি যোগ হয়ে, খাদ্যপণ্যে আরও চড়া মূল্যস্ফীতির আরেক উৎস হয়ে উঠেছে ভোজ্যতেল। কারণ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যশিল্প থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির হাজারো ধরনের খাবার প্রস্তুতে এটি অপরিহার্য উপকরণ।
বিরূপ আবহাওয়াও আরেক নির্মম পরিহাস। খরার কারণে গত বছর কানাডায় ক্যানোলা (রেপসিড) ফসলের উৎপাদন কম হয়। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের ফলন কমাতেও খরা দায়ী ছিল।
পাম তেল, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খাওয়া উদ্ভিজ্জ তেল। মহামারির কারণে এ শিল্পটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এসময় কোভিড-১৯ সংক্রমণ রোধে পাম বাগানে অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের সুযোগ বন্ধ করে মালয়েশিয়া। এতে গত বছর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পাম তেল উৎপাদক দেশটিতে উৎপাদন ৪০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন হয়।
স্থানীয় বাজারে সরবরাহ সংকট এবং মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে, আর্জেন্টিনা এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো তেল উৎপাদনকারী দেশগুলি রপ্তানি বন্ধ বা সীমিত করে সংরক্ষণবাদী ব্যবস্থা নিয়েছে।
গত মার্চে আর্জেন্টিনা সয়াবিন তেলের রপ্তানি নিবন্ধন বন্ধ করে দেয় কারণ তখন খরা দেশটির সয়াবিন ফলনকে প্রভাবিত করেছিল। দেশটি গত বছর বিশ্বব্যাপী সয়া তেল সরবরাহের ৪৮ শতাংশ করেছিল। ইন্দোনেশিয়াও মার্চে একটি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়, যা সম্প্রতি তুলে নেওয়া হয়েছিল।
ইতোমধ্যে, ভোগকারী (আমদানি-নির্ভর) দেশগুলি কর কমিয়ে এবং ভর্তুকিযুক্ত বিক্রয় বাড়িয়ে জনগণের ওপর মূল্যের বোঝা কমাতে লড়াই করছে।
মার্চে তেল পরিশোধনের উপর ১৫ শতাংশ, খুচরা বিক্রিতে ৫ শতাংশ এবং আমদানির ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ। সরকার ভর্তুকি মূল্যে খোলাবাজারে বিক্রির মাধ্যমে (ওএমএস) নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে পণ্যটি বিক্রি করছে।
বাংলাদেশীরা বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহার করে, সে তুলনায় স্থানীয় উৎপাদন প্রায় ২ লাখ টন। আমদানিকৃত ১৮ লাখ টন ভোজ্যতেলের মধ্যে সয়াবিন ৪৬ ও পাম তেল ৫৩ শতাংশ।
বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ পাম তেল আমদানি হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে এবং ২০ শতাংশ মালয়েশিয়া থেকে।
ভোজ্যতেল উৎপাদন ও পরিশোধনে জড়িত টিকে গ্রুপের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তারিক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, “ইন্দোনেশিয়া তার পাম ফসলের দুই-তৃতীয়াংশ রপ্তানি করে। অর্থাৎ, দেশটি রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাকে দীর্ঘায়িত করবে বলে মনে হয় না।”
কিন্তু ১৫ দিন থেকে এক মাস কার্যকর একটি সংক্ষিপ্ত রপ্তানি নিষেধাজ্ঞাও বিশ্ববাজারে সরবরাহ ও যোগানের মধ্যে বিশাল ব্যবধান সৃষ্টি করবে। তারিক মনে করেন, একারণে যদি সংগ্রহের বিকল্প উৎস না পাওয়া যায় তাহলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
তেলের অদৃশ্য বোতল দেশের বাজারে সরবরাহের সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে
শনিবার ঢাকার খুচরা বাজারে নন-ব্র্যান্ডের খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। অনেক দোকানে এক লিটারের বোতল না থাকায় ব্যবসায়ীরা দুই লিটার ও পাঁচ লিটার তেলের বোতল বিক্রি করছেন।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, কোম্পানিগুলো মাসখানেক ধরেই সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে এক লিটারের বোতলের সংকট রয়েছে। তবে বেশিরভাগ দোকানিকে সরকার নির্ধারিত প্রতিলিটার ১৬০ টাকায় সয়াবিন বিক্রি করতে দেখা গেছে।
আমদানিকারকদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে টনপ্রতি পাম তেলের দাম ছিল ১৭০০ ডলার এবং সয়াবিনের দাম ছিল এক হাজার ৯৯০ ডলার।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের বাজার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলেছে, নন-ব্র্যান্ডেড সয়াবিন ১৫৫-১৫৮ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন ১৬০-১৭০ টাকা এবং পাম তেল ১৪৫-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তবে শনিবার খোলা পাম তেল পাওয়া গেছে লিটার প্রতি ১৭০-১৯০ টাকায়।
রাজধানীর কারওয়ানবাজারের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী আরিফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, “কোম্পানিগুলি চাহিদার তুলনায় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কম সরবরাহ করছে। এ কারণেই তেলের সংকট রয়েছে।”
এ বাজারের আরেক তেল ব্যবসায়ী শফিকুল জানান, তারা নিয়মিত ক্রেতা ছাড়া কারো কাছে তেল বিক্রি করছেন না। তিনি বলেন, সরবরাহের ঘাটতি তাদের বেছে বেছে বিক্রিতে বাধ্য করেছে।
এলসি খোলা কমে যাওয়াও বিপদ সংকেত দিচ্ছে
খাতুনগঞ্জের ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ সওদাগর বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বুকিং রেট বেড়ে যাওয়ায় আগামী দিনে ভোজ্যতেলের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে প্রায় ৫ লাখ ৩৬ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। এ সময়ে প্রায় ৬ লাখ ৬৩ হাজার টন পাম তেল আমদানি করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যে দেখা গেছে, রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে গত তিন মাসে তেল আমদানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ লাখ ২২ হাজার টন। এর মধ্যে, সয়াবিন আমদানি হয়েছে প্রায় ৩ লাখ ৬৩ হাজার টন, পাম তেল আমদানি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৫৯ হাজার টন।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিমাসে সয়াবিন তেলের চাহিদা এক লাখ টন। মাসিক চাহিদার প্রায় ৬৫,০০০ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করে মেটানো হয়।
কিন্তু গত মার্চে মাত্র ১৪ হাজার টন সয়াবিন আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা হয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত খুচরা মূল্য বিশ্ববাজারের তুলনায় কম। তাই, আমদানিকারকরা এ ব্যবসা থেকে দূরে সরে আসছেন, যা আগামী দিনের জন্য আরও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। ব্যবসায়ীদের মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে খুচরা সয়াবিনের দাম প্রতিলিটার ১৬৫-১৭৪ টাকা- যা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম। নাম না প্রকাশের শর্তে বেশ কয়েকজন আমদানিকারকও জানান, লোকসানের আশঙ্কায় তারা এলসি খোলা কমিয়েছেন।
খবর সূত্র : বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড