শুক্রবার, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৫
spot_img
Homeটপ নিউজআমেরিকাকে ভাবাচ্ছে ঘরে ঘরে ‘অস্ত্র’

আমেরিকাকে ভাবাচ্ছে ঘরে ঘরে ‘অস্ত্র’

প্রাইম ভিশন ডেস্ক »

আমেরিকানরা এখন আর বন্দুকধারীর গুলিতে মানুষ হত্যার খবর শুনে চমকে ওঠে না। অনেকটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে এটি। ঘরে-বাইরে, উপাসনালয়ে, স্কুলে, নাইটক্লাবে, বারে কিংবা বড় কোনো উৎসবে একের পর এক বন্দুক হামলায় সাধারণ নাগরিক নিহতের খবর মার্কিনিদের অসাড়-অনুভূতিহীন করে তুলেছে। ২০১৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ইসলা ভিস্তাতে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহতের ঘটনার পর দ্য ওনিয়ন লিখেছিল, ‘এটা প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই এবং আমেরিকাই একমাত্র দেশ যেখানে রুটিনমাফিক প্রতিনিয়ত এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে!’

কিন্তু সত্যিই কি এই নির্বিচারে হতাকাণ্ড প্রতিরোধের কোনো উপায় নেই? কারণ ২০২২ সালের এসেও আমেরিকাবাসীকে দেখতে হচ্ছে সেই একই চিত্র।

গতকাল ২৪ মে (মঙ্গলবার) যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে ঘটে গেছে এক নির্মম হত্যাকাণ্ড। উভালদে এলাকার রব এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছে ১৯ শিশুসহ ২১ জন।

সালভাদর রামোস নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ একটি এআর-১৫ রাইফেলের সাহায্যে এই হত্যাকাণ্ড চালায়। ‘এডউইক’ নামক শিক্ষা গবেষণার তথ্যানুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। ফলে দেশের নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তো পড়েছেই, সাথে জনমনে আতঙ্কও বেড়েছে।

তবে বাস্তবতা বলছে, দ্য ওনিয়ন আসলে সত্যি কথাই বলেছে। আমেরিকাই ‘একমাত্র দেশ’ যেখানে বন্দুক হামলা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাছাড়া, ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সংখ্যায়ও আমেরিকাই শীর্ষস্থানে। শুধু অন্যের গুলিতেই নয়, নিজেরা নিজেদের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে আত্মহত্যার দিক থেকে বিশ্ব র্যাং কিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগে শুধু গ্রিনল্যান্ডের অবস্থান। আত্মহত্যার বিষয়টি বাদে, ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, দুর্ঘটনা ও সহিংসতা মিলিয়ে অস্ত্রের গুলিতে নিহতের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ২৮তম। কিন্তু আত্মহত্যার হিসাব বাদেও, ইউরোপ ও এশিয়ার প্রায় সব দেশের চাইতে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক গুণ বেশি।

সাধারণত অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোতেই বন্দুকধারীর গুলিতে সহিংসতার মাত্রা বেশি। এসব দেশের মধ্যে আছে- এল সালভাদর, যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতায় মৃত্যুর সংখ্যা সর্বোচ্চ। এল সালভাদরের মাথাপিছু জিডিপি ৪০০০ ডলার, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের আয়ের মাত্র ৭ শতাংশ এটি। এদিকে ধনী দেশগুলোর মধ্যে লুক্সেমবার্গে বন্দুকের গুলিতে নিহতের সংখ্যা সবচেয়ে কম। কিন্তু আমেরিকাই একমাত্র দেশ যেখানে মাথাপিছু জিডিপি অনেক বেশি (বিশ্বে ৮ম) এবং একই সাথে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতার হারও অনেক বেশি (বিশ্বে ১২তম)।

বিশ্বব্যাংক এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন এর গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস সার্ভের ডেটা অনুযায়ী, ধনী দেশগুলোর মধ্যে জাপান, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মৃত্যর হার শূন্য।

কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যার সাথে আগ্নেয়াস্ত্র মজুদ থাকার সম্পর্ক রয়েছে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি বছর লাখ লাখ আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন করছে এবং তার চেয়েও বেশি আমদানি করছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলের প্রথম মেয়াদে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র উৎপাদন নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় যুক্তরাষ্ট্রে। কারণ অনেকেরই ভয় ছিল যে, আট বছরের রিপাবলিকান হোয়াইট হাউজের অবসানের পর আগ্নেয়াস্ত্র-নিয়ন্ত্রণে বিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট ওবামা দেশের জনগণের অস্ত্র রাখার অধিকার কেড়ে নিবেন।

কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ২০১৭ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে হ্যান্ডগান, শটগান ও রাইফেলের সংখ্যা তার আগের দুই দশকের চেয়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার চাইতে বেশি।

বিভিন্ন দেশের হিসাবে আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যার দিক থেকে কানাডার নামও চলে আসে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, কানাডায় বন্দুকের গুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা বেশ কম। আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে মৃত্যুহারের দিক থেকে কানাডার অবস্থান বিশ্বে ৭২তম। এমনকি কানাডায় প্রতি তিনজন নাগরিকের মধ্যে একজনের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও, দেশটিতে অস্ত্র সহিংসতার হার যুক্তরাষ্ট্রের ১০ ভাগের ১ ভাগ। কানাডায় বন্দুক হামলায় মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও, ২০১৬ সালে সেখানে মৃতের সংখ্যা ২২৩ জন এবং একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রে মৃতের সংখ্যা ১৪ হাজার!

কানাডায় বন্দুক কিনতে হলে আগে একটি সুপারিশনামা দেখাতে হয়, আগ্রহী ক্রেতার ব্যক্তিগত ইতিহাস খতিয়ে দেখা হয় এবং লাইসেন্স দেওয়ার আগে গান-সেফটি কোর্স করানো হয়। নতুন অস্ত্রের লাইসেন্স পেতেও ২৮ দিন অপেক্ষা করতে হয় কানাডিয়ানদের। স্কুলে বন্দুক হামলার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই এআর-১৫ রাইফেল ব্যবহৃত হয়, যা মঙ্গলবার টেক্সাসের ঘটনায়ও দেখা গেছে। ফ্লোরিডা, পার্কল্যান্ড, অরোরা, কলোরাডোর বিভিন্ন উপাসনালয়ে বা সিনেমা দর্শকদের উপর এই বন্দুক দিয়ে হামলা চালাতে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এই এআর-১৫ বন্দুকটি কানাডায় একটি ‘নিয়ন্ত্রিত’ অস্ত্র। সেখানে এই অস্ত্র কিনতে চাইলে ক্রেতাকে অবশ্যই বাড়তি একটি পরীক্ষায় পাস করতে হবে এবং বিশেষ লাইসেন্স নিতে হবে।

কিন্তু বারাক ওবামা যদি বন্দুক ক্রয়ের ক্ষেত্রে আরো কঠোর আইন প্রয়োগ করতেন, তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র উপকৃত হতো? হয়তোবা! কারণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষিতে দেখা গেছে, অস্ত্র ক্রয়ের আইনের উপর ভিত্তি করে বন্দুক হামলায় মৃত্যুর হার কমবেশি হয়। ২০১৮ সালে ‘জেএএমএ ইন্টারনাল মেডিসিন’-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে দেখা যায়, কঠোর আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় নীতি দেশে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আত্মহত্যা ও অস্ত্র হামলা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। ২০১৮ সালে নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, জনবহুল স্থানে বন্দুক হামলায় ব্যবহৃত প্রায় সব অস্ত্রই অবৈধভাবে সংগৃহীত।

গিফোর্ডস ল সেন্টার টু প্রিভেন্ট গান ভায়োলেন্স এরই মধ্যে লুইজিয়ানা ও আলাস্কা অঞ্চলের অস্ত্র-নিরাপত্তা আইনকে ফেইলিং গ্রেড দিয়েছে, অর্থাৎ অকার্যকরী ঘোষণা করেছে। এই দুটি স্থানে অস্ত্র হামলায় মাথাপিছু মৃত্যুর হারও সবচেয়ে বেশি। তবে ম্যাসাচুসেটস, নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি উচ্চ গ্রেড পেয়েছে তাদের কার্যকরী আইনের জন্য।

যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এক জায়গা থেকে অন্যত্র আগ্নেয়াস্ত্র পরিবহন করা যতদিন পর্যন্ত সহজ হবে, (যেমন, অস্ত্রবান্ধব রাজ্য নেভাডা থেকে কঠোর আইন প্রয়োগকারী রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়াতে অস্ত্র নেওয়া), যতদিন পর্যন্ত আইনপ্রণেতারা কঠোর নীতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হবেন এবং মানসিকভাবে অসুস্থদের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করবেন, যতদিন পর্যন্ত রাজনীতিবিদরা বন্দুক শিল্প থেকে টাকা নেওয়া চালিয়ে যাবেন, যতদিন পর্যন্ত গান লবির মাধ্যমে ডাক্তারদের চাপ দেওয়া হবে রোগীদের সঠিক পরামর্শ দিতে এবং যতদিন পর্যন্ত এআর-১৫ বন্দুকের এক বক্স গুলির দাম মাত্র ২০-৫০ ডলার থাকবে, ততদিন পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্দুক হামলার সমস্যা চলতেই থাকবে।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

পাঠক প্রিয়

সৌদি-মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের জন্য কমলো বিমানের ভাড়া

চবিতে ১০ জন ছাত্রীকে বহিষ্কার