শনিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
spot_img
Homeএই মুহুর্তে৬২ প্রতারক আপনার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে !

৬২ প্রতারক আপনার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে !

প্রাইম ডেস্ক »

কয়েক বছর আগেও আশপাশের গ্রাম ছাড়া দেশের কেউ বর্তমানে আলোচিত গ্রামটির নাম চিনত না। এ গ্রামের নির্দিষ্ট মানুষ ছিল অভাবী। তাদের ছিল ছাপরা ঘর। কিন্তু সম্প্রতি বদলে গেছে সেই চিত্র। যাদের ঘরে ভাত জুটত না তারাই এখন হাজার হাজার টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরেন। সেই গ্রামের এখন জোরেশোরে নির্মাণ হচ্ছে পাকা দালান।

রহস্যময় গ্রামটি ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে অবস্থিত। ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া নামের গ্রামটি এখন পুলিশসহ মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়বস্তু। শুধুমাত্র প্রতারক চক্র থাকায় গ্রামটি আজ আলোচনায় এসেছে। সেই গ্রামে বাস করছেন ৬২ জনের একটি প্রতারক চক্র।

৬২ জন প্রতারক চক্রের সদস্যদেই পকেটে হাজার টাকা ও তাদের বাড়িতে গড়ে উঠছে পাকা দালান। কোনো প্রকার পরিশ্রম করে নয়, মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই এ অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তারা। এ ডিজিটাল প্রতারকেরা স্থানীয়ভাবে ‘টোপ পার্টি’র সদস্য হিসেবে পরিচিতি।

পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরের একটি ডিজিটাল প্রতারণা মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পশ্চিম পাড়া গ্রামে ৬২ জন সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সন্ধান পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

কিন্তু ফরিদপুর জেলা পুলিশের তদন্ত বলছে, ডুমাইনের পশ্চিম পাড়া গ্রামে প্রতারক চক্রের সদস্য সংখ্যা ৭৭। পাশের ডুমাইন গ্রাম মিলে সংখ্যাটি ৯৫ দাঁড়িয়েছে। আশপাশের গ্রাম ও এলাকাতে ছড়িয়ে পড়ছে এ চক্রের সদস্য সংখ্যা।

সিআইডির তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, পশ্চিম পাড়ার শাহারুপ শেখের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মধুখালী থানায় দুটি মামলা থাকার তথ্য মিলেছে। এছাড়া ময়নাল শেখ, ওবায়দুল কাজী, রতন শেখ, সাগর কাজী, তপন শেখ, মেহেদী হাসান, মিলন শেখ, মিঠুন শেখ, আশরাফুল শেখ, ইলিয়াস শেখ, রিপন শেখ ও আবদুল কাদের শেখের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত সব ডিজিটাল প্রতারণার মামলা হয়েছে।

২০২০ সালের ১৮ ডিসেম্বর ফরিদপুরের এসপি মো. আলিমুজ্জামান ‘টোপ পার্টি’র সদস্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানিয়ে একটি সমাবেশ করলে সেখানে টোপ পার্টির ৯৫ জন অপরাধের পথ থেকে ফিরে আসার শপথ নেন। তবে এলাকাবাসীর দাবি, অপরাধে জড়িতরা কেউ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেননি।

পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, টোপ পার্টির উৎপত্তি ডুমাইনে। তবে তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। মধুখালীর ডুমাইন বর্তমানে একটি অচ্ছুত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পড়েছে। অপরাধীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসীর উদ্যোগ দরকার। পুলিশও সবধরনের সহায়তা করবে।

সিআইডির তদন্ত সূত্র থেকে জানা যায়, রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মধুখালীর পশ্চিম পাড়া গ্রামের ৬২ জন প্রতারকের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা বের করা হয়। প্রতারক চক্রের সদস্যরা কয়েক বছর ধরে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলো বলে অভিযোগে মামলাটি হয়। এ মামলায় গত ২৮ মার্চ তাঁদের বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রভুক্ত ১৫ জনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকার প্রমাণ মিলেছে। এ মামলায় আরো ১০ জন রয়েছেন, যাদের সবার বাড়ি ডুমাইনে। তবে পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পাওয়ায় তাদের অভিযোগপত্রভুক্ত করা হয়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইম বিভাগের এসআই এমদাদুল কবির বলেন, পশ্চিম পাড়ার ৬২ জন লোক ডিজিটাল প্রতারণায় জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে আটজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন। তাঁদের জবানবন্দিতে মোট ৬৪ জনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য মিলেছে। এর মধ্যে ১৫ জনকে গ্রেফতার করলেও বাকিরা পলাতক।

যেভাবে শনাক্ত হয় ‘টোপ পার্টি’

পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গত বছরের ১৯ জানুয়ারি প্রতারণার ফাঁদে ফেলে ১ লাখ ৭ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন বীথিকা গড়াই নামের একজন গ্রাহক। মামলায় কারও নাম উল্লেখ না করলেও প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি নম্বর ছিল। দুটি মুঠোফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ডের (সিডিআর) সূত্র ধরে প্রথমে গ্রেফতার হন ইকবাল শেখ ও আবদুল কাদের শেখ। দুজনই মধুখালীর পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা। গত বছরের ২৮ মার্চ তারা আদালতে স্বীকারোক্তি দেন। এ দুজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একে একে ১৫ জনকে গ্রেফতার করে সিআইডি।

যেভাবে প্রতারণা শুরু

মামলার অভিযোপত্র থেকে জানা গেছে, অর্থের বিনিময়ে বিকাশের বিভিন্ন দোকানে টাকা পাঠানোর খাতার ছবি সংগ্রহ করেন এ চক্রের সদস্য সোহান, ইকলাছ, ময়নাল ও খায়ের। পরে তা প্রতারক চক্রের সদস্যদের কাছে পাঠানো হয়। এরপর নিজেদের দোকানদার পরিচয় দিয়ে ভুলে টাকা চলে গেছে বলে গ্রাহকের কাছে দাবি করেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। পরে গ্রাহকের বিকাশ নম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। প্রতারণার ফাঁদে পড়া গ্রাহকেরা পিন নম্বর দিয়ে দেন। তখন প্রতারক চক্র বিকাশ নম্বর চালু করার ফাঁদ পেতে টাকা আদায় করে থাকেন।

ভুক্তভোগী বীথিকা গড়াই বলেন, একজন ফোন করে আমাকে বলেছিল, আপনার নম্বরে টাকা চলে গেছে। ভুল করে বিকাশ অফিসে ফোন করে আপনার নম্বর বন্ধ করে দিয়েছি। পরে আরেকটি নম্বর থেকে আমার মোবাইলে কল আসে। তখন বিকাশ নম্বর সচল করতে আমার পিন নম্বর জানতে চাইলো। এভাবেই আমি প্রতারকদের ফাঁদে পড়ি।

তদন্ত প্রতিবেদনে সিআইডি আদালতকে বলেছে, প্রতারকেরা যেসব মুঠোফোন ব্যবহার করেন, তা ভুয়া। এই সিমগুলো সংগ্রহ করেন আসামি রমজান, সোহান ও ময়নাল।

বদলে যাচ্ছে ডুমাইনের পশ্চিমপাড়া

যে গ্রামে কয়েকদিন আগে পাকা বাড়ি নির্মাণ অল্প ছিল সে গ্রামে নতুন নতুন বাড়ি নির্মাণ হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে তারাই নতুন বাড়ি নির্মাণ করছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, কয়েক বছর আগে তাদের আর্থিক অবস্থা করুণ ছিল। তাদের ঘর ছিল ছাপরা। আজ তাদের পকেটে হাজার হাজার টাকা। তারা জানান, যারা প্রতারণার সঙ্গে জড়িত তারা মাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে।

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -spot_img

পাঠক প্রিয়