প্রাইম ভিশন ডেস্ক »
বৃহস্পতিবার আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রাকালে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট এআই১৭১ গুজরাটের বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি আবাসিক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। বোয়িংয়ের তৈরি ড্রিমলাইনার মডেলের এই উড়োজাহাজটিতে ২৪২ জন যাত্রী ছিলেন। ১ জন বাদে বাকি সবারই মৃত্যু ঘটেছে। মারা গেছেন, বিমানটি যে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের ওপর আছড়ে পড়ে—সেখানকার ৬ শিক্ষার্থীও। হতাহতের সংখ্যা বাড়তেও পারে আরও।
উড্ডয়নের পরপরই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো সাধারণত সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ধাপ বলে মনে করা হয়। ২০১১ সালে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে এই প্রথমবার কোনো বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার এত বড় প্রাণহানির ঘটনার শিকার হলো।
দুর্ঘটনার কারণ জানতে ভারতীয় তদন্তকারীদের সঙ্গে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরাও তদন্তে যোগ দিচ্ছেন।
দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে জানতে একাধিক বিমান বিশেষজ্ঞ ও ভারতের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিয়মিত বোয়িং ৭৮৭-৮ চালানো অভিজ্ঞ পাইলটদের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। উড্ডয়নের কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কীভাবে বিমানটি আহমেদাবাদের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় ভবনের ওপর ভেঙে পড়ল, সে বিষয়ে নানা সম্ভাব্য কারণের কথা জানিয়েছেন তারা।
উচ্চতা অর্জনে হিমশিম
বিমানটি বৃহস্পতিবার দুপুর ১টা ৩৯ মিনিটে (স্থানীয় সময়) আহমেদাবাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে। উড্ডয়নের কিছুক্ষণের মধ্যেই ককপিট থেকে ‘মে-ডে’ সংকেত পাঠানো হয়—তবে এরপর আর কোনো যোগাযোগ করা যায়নি।
বিমানটি চালাচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন সুমিত সাবহারওয়াল ও কো-পাইলট ক্লাইভ কুন্ডার। তাদের মিলিত ফ্লাইট অভিজ্ঞতা ৯ হাজার ঘণ্টার বেশি। সাবহারওয়াল একজন অভিজ্ঞ পাইলট, যিনি ২২ বছরেরও বেশি সময় ধরে পেশাগতভাবে বিমান চালিয়েছেন।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমকে বিমানের একমাত্র বেঁচে ফেরা যাত্রী জানিয়েছেন, তিনি একটি ‘প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ’ শুনেছিলেন এবং লক্ষ্য করেন যে বিমানটি উচ্চতা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছিল।
বিবিসি ভেরিফাই-এর যাচাইকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানটি আবাসিক এলাকার ওপর দিয়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ফ্লাইট ডেটা অনুসারে, বিমানটি ৬২৫ ফুট (প্রায় ১৯০ মিটার) উচ্চতা পর্যন্ত উঠেছিল। এরপর তা ক্রমশ নিচে নামতে শুরু করে এবং গাছপালা ও ভবনের আড়ালে চলে যায়। পরে একটি বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে।
বিবিসি ভেরিফাই পর্যবেক্ষণ করা সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, বিমানটি আকাশে ছিল মাত্র ৩০ সেকেন্ড।
বিরল ‘ডাবল ইঞ্জিন ফেলিওর’?
আহমদাবাদে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এখনও নিশ্চিত নয়। স্বল্প সময়ের উড্ডয়নের ভিডিও বিশ্লেষণ করে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা অসম্ভব। একাধিক বিশেষজ্ঞের মতে, ভিডিও ও প্রাথমিক তথ্যে বোঝা যাচ্ছে, বিমানটি পর্যাপ্ত থ্রাস্ট [আকাশে উঠার শক্তি] পাচ্ছিল না। কেউ কেউ বলছেন, সম্ভবত উড্ডয়নের পরপরই দুই ইঞ্জিনই বিকল হয়ে পড়েছিল—যা অত্যন্ত বিরল একটি ঘটনা।
একজন অভিজ্ঞ পাইলট বলেন, ‘যদি উড্ডয়নের ঠিক পরই উভয় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, তবে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময়ই থাকে না পাইলটের হাতে।’
তবে সাবেক পাইলট মার্কো চ্যান জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া ভিডিওতে এমন কোনো দৃশ্য বা শব্দ নেই যা ডাবল ইঞ্জিন ফেলিওরের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
তদন্তকারীরা আগামী দিনে ব্ল্যাক বক্সের [বিমানের গুরত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষণ থাকে এ ডিভাইসে] ডেটা ও ধ্বংসাবশেষ পরীক্ষা করে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালাবেন।
বোয়িং ৭৮৭-৮-এ র্যাম এয়ার টারবাইন (র্যাট) নামে একটি জরুরি ব্যাকআপ ব্যবস্থা রয়েছে, যা মূল ইঞ্জিন ব্যর্থ হলে হাইড্রোলিকসসহ অন্যান্য কিছু সিস্টেম চালু রাখতে সাহায্য করে। এই ব্যবস্থাটি সক্রিয় হয়েছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২০০৯ সালে নিউ ইয়র্কে ইউএস এয়ারওয়েজের একটি বিমান বার্ড স্ট্রাইকের কারণে একইরকম ডাবল ইঞ্জিন ফেলিওরের মুখোমুখি হয়েছিল, তবে পাইলট সেটিকে নিরাপদে হাডসন নদীতে নামাতে পেরেছিলেন। এটি নিয়ে পরে একটি সিনেমাও বানানো হয়েছিল। টম হ্যাংকস অভিনীত ওই সিনেমার নাম ছিল ‘সালি’।
একজন জ্যেষ্ঠ পাইলট বিবিসি-কে বলেছেন, জ্বালানিতে দূষণ কিংবা জ্বালানির প্রবাহে বিঘ্ন ঘটলেও এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিমানের ‘ফুয়েল মিটারিং সিস্টেম’ যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ইঞ্জিনে জ্বালানি পৌঁছায় না এবং তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞ মোহন রঙ্গনাথনও বলছেন, ডাবল ইঞ্জিন ফেলিওর হলে তা হবে ‘অত্যন্ত, অত্যন্ত বিরল’ ঘটনা।
এদিকে ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী সংস্থা জিই এরোস্পেস জানিয়েছে, তারা তদন্তে সহায়তা করতে একটি বিশেষজ্ঞ দল ভারতে পাঠাচ্ছে। একইভাবে বোয়িংও জানিয়েছে, তারা এয়ার ইন্ডিয়াকে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে।
কারণ কি ‘বার্ড স্ট্রাইক’?
আহমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পেছনে আরেকটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উঠে এসেছে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ বা বার্ড স্ট্রাইক-এর বিষয়টি। ভারতের একাধিক বিমান বিশেষজ্ঞ ও পাইলট এ সম্ভাবনার কথা বলছেন।
পাখির সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষ অত্যন্ত বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে ইঞ্জিনে পাখি ঢুকে গেলে ইঞ্জিনের শক্তি হারানোর আশঙ্কা থাকে। ঠিক এমন ঘটনা ঘটেছিল ২০২৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ার-এর এক দুর্ঘটনায়, যেখানে ১৭৯ জন নিহত হন।
বিবিসিকে বিমান বিশেষজ্ঞ মোহন রঙ্গনাথন বলেন, আহমদাবাদ বিমানবন্দর ‘পাখির জন্য কুখ্যাত’। তিনি বলেন, ‘ওখানে সবসময়ই পাখির আনাগোনা দেখা যায়।’
একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, আহমেদাবাদ রুটে ফ্লাইট পরিচালনাকারী অন্তত তিনজন ভারতীয় পাইলট।
ভারতের নাগরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গুজরাট রাজ্যে গত পাঁচ বছরে মোট ৪৬২টি বার্ড স্ট্রাইক ঘটেছে, যার বড় অংশই আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সংসদে উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২২–২৩ অর্থবছরে আহমদাবাদে ৩৮টি পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, যা এর আগের বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি।
২০০৯ সালে নিউইয়র্কের লা গার্ডিয়া বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর ২,৭০০ ফুট উচ্চতায় ইউএস এয়ারওয়েজের একটি বিমানে সমুদ্রগুলের ঝাঁক ঢুকে পড়ে। পাইলট দক্ষতার সঙ্গে বিমানটিকে নদীতে অবতরণ করান। তবে আহমেদাবাদের দুর্ঘটনায় বিমানের কাছে তেমন উচ্চতা বা সময়—কোনোটিই ছিল না।
তবে একজন জ্যেষ্ঠ পাইলট জানিয়েছেন, সাধারণত বার্ড স্ট্রাইক একসঙ্গে দুইটি ইঞ্জিনকে ক্ষতিগ্রস্ত না করলে সেটি বড় ধরনের বিপর্যয় তৈরি করে না। ফলে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের আশঙ্কা থাকলেও, সেটিই এককভাবে দুর্ঘটনার মূল কারণ কিনা, তা নিশ্চিত হতে সময় লাগবে।
‘ফ্ল্যাপস সেটিং’ ভুল ছিল?
উড়ানের সময় বিমানের ফ্ল্যাপ ঠিকমতো খোলা ছিল না—এমন সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করছেন একাধিক বিশেষজ্ঞ। বিবিসি ভেরিফাইকে তিনজন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বিমানটির ফ্ল্যাপ সঠিকভাবে না খোলার কারণে উড্ডয়নে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তবে অন্য কিছু পাইলট এবং বিশ্লেষক এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন।
উড্ডয়নের সময় ফ্ল্যাপ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এগুলো বিমানের ডানার পেছনের অংশে থাকে। বিমানের যখন কম গতিতে বেশি উত্তোলন শক্তি [লিফট] প্রয়োজন হয়, তখন ফ্ল্যাপ ব্যবহার করা হয়—যাতে বিমান মসৃণভাবে উড়তে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ফ্ল্যাপ ঠিকভাবে না খোলা হয়, তবে যাত্রী, কার্গো, পূর্ণ জ্বালানি ও গরম আবহাওয়ার ভারে বিমান রানওয়ে থেকে উঠতেই পারবে না।
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, বিমানটিতে প্রায় ১০০ টন জ্বালানি ছিল, যা একটি দীর্ঘপথের ফ্লাইটের জন্য পূর্ণ ধারণক্ষমতা বলেই ধরা হয়।
বৃহস্পতিবার আহমেদাবাদে তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন পরিস্থিতিতে বাতাস অপেক্ষাকৃত পাতলা হয়ে যায়, ফলে বিমানের উড্ডয়নে আরও বেশি ফ্ল্যাপ সেটিং ও ইঞ্জিনের থ্রাস্ট প্রয়োজন হয়। একজন পাইলট বলেন, এমন উচ্চ তাপমাত্রায় সামান্য কনফিগারেশন ত্রুটিও মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
বিকেলে প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, বিমানটি আহমেদাবাদ থেকে উড্ডয়নের সময় উচ্চতা অর্জনে হিমশিম খাচ্ছিল এবং অল্প সময় পরেই নিচে নেমে এসে বিধ্বস্ত হয়।
তবে ৭৮৭ ড্রিমলাইনারে রয়েছে টেক-অফ কনফিগারেশন ওয়ার্নিং সিস্টেম, যা ফ্ল্যাপ না খোলা থাকলে পাইলটকে সতর্কবার্তা দেয়। একজন পাইলট বিবিসিকে বলেন, যদি ফ্ল্যাপ খোলা না থাকত, তাহলে ওয়ার্নিং সিস্টেম তাৎক্ষণিকভাবে পাইলটকে সতর্ক করত।
সাবেক পাইলট মার্কো চ্যান বলেন, এখনও পর্যন্ত পাওয়া ভিডিও ফুটেজ খুব বেশি বিকৃত, তাই ফ্ল্যাপ খোলা ছিল কি না—সেটি নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে তিনি এটিকে ‘খুব অস্বাভাবিক’ ঘটনা বলেই অভিহিত করেছেন।
‘ফ্ল্যাপ সাধারণত পাইলটরাই উড্ডয়নের আগে নিজ হাতে নির্ধারণ করেন। এ সংক্রান্ত একাধিক চেকলিস্ট ও প্রক্রিয়া রয়েছে,’ বলেন চ্যান। ‘তাই যদি সত্যিই ফ্ল্যাপ ঠিকভাবে সেট না হয়ে থাকে, তাহলে সেটি মানবিক ভুলের দিকেই ইঙ্গিত করে।’